পানিশূন্য নদীতে শ্রমিকরা নুড়ি পাথর তুলছে। সামান্য টাকায় তারা পাথর বিক্রি
করে সংসার চালাচ্ছে। তবে যমুনা সেতু নির্মাণের আগে পঞ্চগড়সহ উত্তরাঞ্চলে
নিদারুণ অভাব ছিল। ছিল না ভালো যোগাযোগব্যবস্থা। পঞ্চগড়ের সমতল ভূমিতে
সৃষ্টি হলো চা-বাগান। চা-ফ্যাক্টরি, জেমকন, জেমজুট ও অন্যান্য ব্যবসায়
প্রতিষ্ঠান। হলো অর্থনীতির আমূল পরিবর্তন। পঞ্চগড়ের পাথর অর্থনৈতিক
উন্নয়নের সিঁড়ি হিসেবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে।
পঞ্চগড় যেন পাথরের খনি। ৫০-৬০ বছর ধরে কয়েক হাজার পাথরশ্রমিক পাথর উত্তোলন করে আসছেন। এখান থেকে প্রতিদিন ২০০-৩০০ ট্রাক পাথর রফতানি হচ্ছে। এখানে সমতল ভূমি খনন করলেই পাথর পাওয়া যায়। টাকার বিনিময়ে প্রথমে মাটির নিচে থাকা পাথর কিনতে হয়। তারপর, পাঁচ-সাত ফুট মাটি খনন করে পাথর বের করতে হয়। এ গভীরতা কোথাও ৩০ ফুট আবার কোথাও ৭০ ফুট। কোথাও ১০-১২ ফুট পাথরের গভীরতা রয়েছে। এসব পাথর উত্তোলনে শ্যালোমেশিনে পানি সেচের ব্যবস্থা করতে হয়। শ্রমিকেরা পাঁচ-সাতজন মিলে দল বেঁধে পাথর উত্তোলন করেন। প্রতিদিন গড়ে ৪-৫ ঘণ্টা পাথর তুলে ৪০০-৫০০ টাকা আয় করেন। মহানন্দা, করতোয়া, তালমা, তিরনই, ডাহুকসহ বিভিন্ন নদীতে পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে। এসব নদীর উৎস ভারত। মহানন্দা নদী আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বাংলাবান্ধা থেকে শুরু করে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত দু’দেশের সীমানা দিয়ে প্রবাহিত। নদীর এপারে তেঁতুলিয়া, ওপারে ভারতের হাতিয়া গছ ও শিলিগুড়ি। একটু দূরেই ভারতের রেলস্টেশন ও বাগডোগরা বিমানবন্দর। ফুলবাড়িতে রয়েছে স্লুইস গেট। ভারতীয় কর্তৃপ কখনো স্লুইস গেট বন্ধ রাখে আবার কখনো খুলে দেন। খুলে দিলেই পানির স্রোতে বিভিন্ন আকৃতির প্রচুর নুড়িপাথর ভেসে আসে। পঞ্চগড়ে নদী-নালা, খাল-বিল এবং সমতল ভূমি, আবাদি জমিÑ যেখানেই খোঁড়াখুঁড়ি, সেখানেই পাথর। কোথাও কম, কোথাও বেশি। প্রতি বছর এখান থেকে হাজার হাজার মেট্রিক টন পাথর উত্তোলন করে, বিভিন্ন জেলায় রফতানি করা হচ্ছে। এখানকার পাথর দিয়ে বাড়িঘর, রাস্তা-ঘাট, সেতু, কালভার্ট নির্মাণ করা হচ্ছে। সারা দেশের প্রয়োজনীয় ৭০ শতাংশ পাথর এখান থেকে সরবরাহ হয়ে থাকে।
বিভিন্ন নদী থেকে পাথর উত্তোলনে কোনো মাটি কাটার প্রয়োজন পড়ে না। সমতল ভূমি থেকে পাথর উত্তোলনে শ্রমিকদের একটু পরিশ্রম করতে হয়। শ্রমিকেরা কষ্ট সহ্য করেন, ঘাম ঝরিয়ে পাথর তোলেন। অথচ পাথরের মূল্য পান অতি সামান্য। পাথরশ্রমিক কারা? যারা সমতল ভূমি খনন করে পাথর উত্তোলন ও নদী থেকে পাথর সংগ্রহ করেন তারাই পাথরশ্রমিক। নদীতে যখন পানি কম থাকে, তখনই শুরু হয় উত্তোলনের মওসুম। বর্ষা মওসুমে পানি বেশি থাকায় পাথর উত্তোলনে সমস্যা হয়। পঞ্চগড়ে পাথর বিক্রির বাজার সবখানে। বাংলাবান্ধা থেকে তেঁতুলিয়া হয়ে পঞ্চগড়। বিরাট জনপদের সাথে বাংলাবান্ধা, খয়খেটপাড়া, তিরনই, সিপাইপাড়া, রণচণ্ডি, বুড়াবুড়ি, ভজনপুর, শালবাহান, মাগুড়মারি, জগদল, গোয়ালঝাড়, দেবনগর, পঞ্চগড় প্রভৃতি বাজারে পাথর বিক্রি হয়ে থাকে।
পাথরশ্রমিকেরা যে পাথর উত্তোলন করেন, তা ফড়িয়া পাইকারের কাছে বিক্রি করেন।
তারা গড়ে প্রতি সিএফটি পাথর ২৩ থেকে ২৫ টাকা দামে ক্রয় করেন। তারপর সেসব
পাথর মহিলা শ্রমিক দিয়ে বাছাই করেন। বড় বড় বোল্ডার পাথর মেশিনের সাহায্যে
ভাঙা, সাইজ ও বাছাই করে নেন। বিভিন্ন সাইজের পাথর বড় মহাজনের কাছে বিভিন্ন
দামে বিক্রি করেন। ছোট বড় পাথর ভাঙা বা সাইজ করার মতো কয়েক হাজার মেশিন
রয়েছে। এগুলোতে নারী-পুরুষ উভয় শ্রেণীর শ্রমিক কাজ করেন। নারীশ্রমিকদের
হাড়ভাঙা খাটুনি যেকোনো শ্রমিকের শ্রমকে হার মানায়। পাথর কেন্দ্র করে
পঞ্চগড়ে জীবনযাত্রার মান বদলে গেছে। মাটির নিচে প্রকৃতিগতভাবে পাথরের
সন্ধান মেলে। আবাদি জমি থেকে পাথর উত্তোলনে বদলে যাচ্ছে ভূপ্রকৃতি। পঞ্চগড়ে
প্রাকৃতিক পরিবেশ হারাতে বসেছে। ঘটতে পারে ভূমিধসসহ ঝুঁকিপূর্ণ ঘটনা। তা
ছাড়া, ভূগর্ভস্থ এই পাথর উত্তোলনের জন্য নীতিমালা নেই। এ সুযোগে অসাধু
ব্যবসায়ী অবাধে পাথর উত্তোলন করে যাচ্ছে। ফাঁকি দিচ্ছে বিপুল পরিমাণ সরকারি
রাজস্ব। পরিবেশবিদেরা মনেপ্রাণে চান পাথর উত্তোলনে থাকুক রাষ্ট্রের
নজরদারি। আদায় হোক রাজস্ব।
আবদুস সালাম নামে এক পাথরশ্রমিক বললেন, পাথরই তাদের অর্থের জোগানদাতা। উত্তরাঞ্চলে কোনো কলকারখানা বা শিল্পপ্রতিষ্ঠান নেই। আমরা সারা দিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পাথর তুলি। কষ্টের তুলনায় মজুরি অতি সামান্য। কথা হয় ইয়ানগর গ্রামের জিয়াউর এবং মোমিনপাড়ার ওসমান গনির সাথে। তারা কেউবা ২০ বছর ধরে আবার কেউ ১৫ বছর ধরে পাথর তুলে আসছেন। কেউবা সপ্তাহে সাত দিন আবার কেউ চার দিন পাথর তোলার কাজ করেন। পুরুষ শ্রমিকেরা নদী বা মাটি খনন করে পাথর তোলেন। অপর দিকে, নারীশ্রমিকেরা পাথর বাছাই, ভাঙা, চালনা, ভেঙে সাইজ করার কাজ করে থাকেন। পুরুষ ও মহিলা শ্রমিক কাজ সমান করলেও মজুরিতে পার্থক্য রয়েছে। পুরুষ শ্রমিকের তুলনায় নারী শ্রমিক ৭০-৮০ টাকা কম পাচ্ছে। মজুরির েেত্র বৈষম্য অবাঞ্ছিত।
সারা দিন কাজ শেষে পড়ন্ত বিকেলে তারা বাড়ি ফেরেন। শ্রমিক জহিরুল জানান, প্রায় ৪০০ টাকার পাথর তুলেছেন এদিন। প্রতি সিএফটি ২০ টাকা দরে বিক্রি করেছেন। শমসের আলী হাতে ও পায়ে মলমজাতীয় ওষুধ লাগাচ্ছেন। যারা নদী বা ডাঙ্গায় পাথর তোলেন তাদের হাত ও পায়ে সাদা দাগ। প্রতিদিন ২০ টাকার ওষুধ লাগান শমসের। জানান, প্রতিদিন সমান কাজ হয় না। তবু প্রতি মাসে প্রায় ১০-১১ হাজার টাকা আয় করছেন।
পাথরশ্রমিকদের সমস্যা অনেক। দেবনগর গ্রামের পজিরুল ১৭ বছর পাথর তুলে সংসার চালাচ্ছেন। শ্রমিক নবকুমার, আনসারুল, খয়ের আলী জানান, প্রতিদিন নদী থেকে ১৫ থেকে ২০ ঘনফুট পাথর তুলি। কিন্তু আমরা ন্যায্য দাম পাই না। সামান্য দামে পাথর বিক্রি করতে বাধ্য হই। আমাদের সংসারে অভাব। ঠাণ্ডা, জ্বর, হাত ও পায়ে ঘা, ডায়রিয়াসহ নানা অসুখ। হাসপাতালে যাওয়ার সময় পাই না। সব ওষুধ কিনতে হয়। আমরা চাই না, আমাদের সন্তান পাথর তুলুক। পাথরশ্রমিকেরা জীবন-জীবিকার যুদ্ধে এতটাই ব্যস্ত যে, নদী থেকে পাথর তোলা আর বিক্রি করা ছাড়া বাইরের জীবন সম্পর্কে তারা সম্পূর্ণ অজ্ঞ। বিনোদন তাদের জীবনে নেই। সারা দিন কঠোর পরিশ্রম, আর রাতে ঘুমানো। অধিক সন্তান আর সংসারের প্রয়োজন মেটাতে সারা বছরই তাদের অভাবের মাঝে বাস করতে হচ্ছে। রংপুর, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন জেলার অভাবী ও নদীভাঙা লোকজন তেঁতুলিয়ায় বাস করছে। তাদের নিজের জায়গা জমি নাই। ’৮০-এর দশক থেকে এসব মানুষ মহানন্দা নদী ও বিভিন্ন জায়গায় মাটি খনন করে পাথর তুলে সংসার চালায়। ‘পাথরেই তাদের জীবন, পাথরেই তাদের প্রাণ।
আমাদের পেইজ :- www.facebook.com/panchagarh0km
আমাদের গ্রুপ:- www.facebook.com/groups/panchagarh0km/
আমাদের ব্লগ:- www.panchagarh0km.blogspot.com
|
No comments:
Post a Comment